art-banner

আওয়ামী ন্যারেটিভের দাফন- ১ম পর্ব

মুরাদ হাসান; লেখক, চিন্তক।

গণঅভ্যুত্থান মূলত ভাষারই উত্থান। পশ্চিমবঙ্গের সাথে আমাদের যে ফারাক তাও মূলত ভাষারই ফারাক। এই ফারাকটা মূলত এনে দিয়েছে একাত্তর এবং চব্বিশ। দুইটা অভ্যুত্থানে বাংলাদেশের আপামর মানুষ যতটা সম্পৃক্ত, কানেক্টেড ও একাত্ম হতে পেরেছে, শ্রেণীর বাইনারি খুইয়ে একে অপরের ভাষা বিনিময় করতে পেরেছে পশ্চিমবঙ্গের সেই এক্সপেরিয়েন্স হয় নাই। দেখবেন, চব্বিশের জুলাই পূর্ব ভাষার সাথে জুলাই পরবর্তী ভাষার মিল নেই। জুলাই ভাষাকে গণনিকটবর্তী করেছে। জুলাই ধূলিসাৎ করেছে আওয়ামী ফ্যাসিস্ট শক্তির সকল ডিসকোর্স। লক্ষ লক্ষ মানুষ কেবল বন্দুকের সামনে দাঁড়িয়ে হাসিনার পতন ঘটাতে পারেনি। যদি লক্ষ লক্ষ মানুষ রাস্তায় গেলে, বন্দুকের নলের সামনে দাড়ালেই আওয়ামী ফ্যাসিস্ট শক্তির পরাজয় নিশ্চিত করা যেতো তাহলে অভ্যুত্থান আরো অনেক আগেই বিএনপি ঘটায়া ফেলতো। ক্ষমতা যে বন্দুকের নলে থাকে না, ক্ষমতা থাকে ভাষায়, আর ভাষা মূলত জনগণের স্পিরিট বা ভাবকে শক্তিতে রূপান্তরিত করে এইটা প্রমাণ করেছে জুলাই অভ্যুত্থান।

জুলাইয়ের যে আরম্ভ এই আরম্ভ এক তারিখে হয় নাই। জুলাইয়ের আরম্ভ হয়েছে চৌদ্দ তারিখে, যেভাবে এর সমাপ্তি ঘটেছে ছত্রিশ তারিখে। এও তো একটা ভাষা, আমরা জুলাইকে আলগা করেছি, বিশ্বের যে এক কাঠামোভিত্তিক সরলরৈখিক ঘূর্ণায়মান ক্যালেন্ডার জুলাই তারও পরিবর্তন করেছে। এইটাও সম্ভব হয়েছে স্বরের মাধ্যমে। জিদের মাধ্যমে। কোন সে জিদ? যতদিন পর্যন্ত খুনি হাসিনার পতন না ঘটবে ততদিন পর্যন্ত জুলাইয়ের সমাপ্তি ঘটবে না। ফলত আমার একটা অন্যতম দাবী হচ্ছে বাংলাদেশের ইংরেজি ক্যালেন্ডারে জুলাইকে যেন ছত্রিশ পর্যন্ত দীর্ঘায়িত করা হয়। আর আগস্ট যেন শুরু ছয় তারিখ থেকে! এইটা কেন দরকার? স্মরণ তথা জিকিরই শক্তি। জুলাইয়ের ভাষাকে তথা ক্যালেন্ডারের জুলাই রূপকে স্থায়ী করতে পারলে অনাগত সময়ের সাথে এইটা জুড়ে যাবে। আমাদের হাজার হাজার প্রজন্ম পূর্ব পুরুষের অভ্যুত্থানের ইতিহাস অটোমেটিক জানতে পারবে। এর মাধ্যমে তারাও আজাদীর লড়াইয়ের স্পৃহা পাবে।

জুলাইয়ের আরম্ভের কথা বলতেছিলাম। চৌদ্দ তারিখ, রাত। এই রাত মূলত সূর্যোদয়ের রাত। আন্দার কেটে ফশর উদিত হওয়ার রাত। জমিনের সমস্ত আইল বিলুপ্ত হয়ে, নদীর সব বাঁধ বিলীন হয়ে একত্রিত হওয়ার রাত। সমস্ত মসজিদ মন্দির একাত্ম হয়ে, মার্কস, কৃষ্ণ, মোহাম্মদ, লালনের এক পাটাতনে বসার রাত। কৃষক শ্রমিক এলিট নন এলিট সবার এক আলিঙ্গনে আলিঙ্গিত হওয়ার রাত। এই দিন ভেস্তে গিয়েছিল খুনি হাসিনার গদির পাটাতন, যেইটা ছিল আওয়ামী মুক্তিযুদ্ধ চেতনা ও রাজাকার বাইনারি। এ ছিল এমন এক বাইনারি যেইটাতে হাসিনার দাশ রাজাকার হলেও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবাহী হিসেবে প্রসিদ্ধি পেতো, দুই বছরের শিশুও যোদ্ধার খেতাব পেতো; মুক্তিযোদ্ধারা রাজাকার হয়ে যেতো স্রেফ আওয়ামী বিরোধিতার কারণে। মুক্তিকামী জনগণকে রাজাকার ট্যাগে দমন করা হতো। যেহেতু রাজাকার ছিল স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি, ফলত সুশীল সমাজ এর একটা বৈধতা দিতো!

শিক্ষার্থীরা তুমি কে আমি কে, রাজাকার বলার মধ্য দিয়ে এই বাইনারি ধূলিসাৎ করেছে। এতোদিন যে ভাষা ছিল তুই রাজাকারের তা রূপান্তরিত হয়েছে আমি রাজাকারের মধ্য দিয়ে। ফলত রাজাকার শব্দে আগে যে দেশদ্রোহী'র বয়ান হাজির ছিল তাতে জায়গা পেল আজাদীর বয়ান। ফলত সমস্ত মুক্তিকামী জনতা এই রাজাকার বর্গে ঠাঁই নিলো। থাকলো কেবল আওয়ামী ফ্যাসিস্ট শক্তি। মুক্তিকামীদের মধ্যে ফ্যাসিস্টের ডিভাইড এন্ড রোলের খেলার সমাপ্তি ঘটলো। শাহবাগ শাপলা এক হয়ে গেল, কেবল আওয়ামী সিলমোহর মারা পাণ্ডারা ব্যতীত। সমস্ত কালচারাল ওয়ার জনতা ভুলে গেল। জনতা গ্ৰহণ করে নিল বাইনারি কেবল একটাই, হয় মজলুম নয় জালিম! আর মজলুম বর্গের নাম হয়ে উঠলো রাজাকার। কেননা এই বর্গে ফেলে আওয়ামী লীগ বহু নিরপরাধ মানুষকে খুন করেছে! এতে আওয়ামী লীগ বিপদে পড়লো। দেখা গেল সমস্ত জনতা এই রাজাকার বর্গে ঠাঁই নিয়েছে, এখন এদের সবাইকে একাত্তরের রাজাকার হিসেবে এড্রেস করলে একাত্তরের লিগ্যাল অস্তিত্ব থাকে না। একাত্তরের অস্তিত্ব না থাকলে খোদ আওয়ামী লীগের অস্তিত্ব থাকে না! এইখানে আওয়ামী লীগ দুইটা বিপদে পড়েছিল, সবাই রাজাকার ট্যাগ নেওয়ার ফলে মানতে তাদের অসুবিধা হচ্ছিল একাত্তরে নিজেদের বয়ান এতে ধূলিসাৎ হয়ে, আর এরা সব ছোট ছোট বাচ্চা। যারা কিনা আবার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। দ্বিতীয়ত রাজাকার না মানলে রাজাকারের যে নতুন অর্থ মুক্তিকামী এর বিপরীতে নিজেদের চেতনাকামী শক্তির অটোমেটিক অর্থ দাঁড়ায় গণবিরোধী ফ্যাসিস্ট শক্তি!

আমি কে তুমি কে, রাজাকার রাজাকার ছিল এই আন্দোলনের মোড় ঘুরানোর প্রথম পয়েন্ট। এর মাধ্যমে হাসিনা রেজিমের অন্যান্য আন্দোলন থেকে এইটা আলাদা সিগনেচার নিয়ে হাজির হয়। হাসিনা এমন একটা অবস্থা তৈরি করেছিল তার পায়ে মাথা দিয়ে এদেশে আন্দোলন করতে হতো। আগে ক্লিয়ার করতে হতো আওয়ামী শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন না, তারাও আওয়ামী লীগের বিরোধী না। এই আন্দোলনের প্রথম রূপটাও এমন ছিল। আমরা জুলাইয়ের শুরুতে ব্যানারও দেখেছি বঙ্গবন্ধুর বাংলায় বৈষম্যের ঠাঁই নাই। বাকশালী মুজিবরে গড মাইনাই আন্দোলন করতে হইতো। এই আন্দোলনও সেইম ছিল। কিন্তু আন্দোলনে অকস্মাৎ এর ব্যতিক্রম ঘটে। মুজিবের বাকশালী চরিত্র জনগণ ফুটিয়ে তুলে। মুজিবের গ্ৰাফিতিতে লেখা হয় বাকশালী, খুনি, ফ্যাসিস্টের পিতা, খুনির পিতা, গুমের কারিগর, সাত কোটি কম্বল চুরদের নেতা! সর্বহারার সিরাজ সিকদারের খুনী হিসেবে মুজিবকে ডাকতে শুরু করে জনতা, জহির রায়হানের গুমকারী হিসেবে মানুষ এড্রেস করে মুজিবকে, বুদ্ধিজীবীরা বলতে শুরু করে তিন বছরে মুজিব চল্লিশ হাজার মানুষকে হত্যা করেছে, ছাত্র-যুবলীগের যে তাণ্ডব তা মূলত শেখ মুজিবের রক্ষীবাহিনীরই অনুকরণ, মিডিয়াকে আওয়ামী লীগে যে রূপান্তর করা এইটা বাকশালের মিডিয়া নিষিদ্ধেরই নয়া সংস্কার, বাকশালের বিরোধী রাজনীতি নিষিদ্ধেরই আপডেট ভার্সন হলো আওয়ামী লীগের বিরোধী দলহীন শাসন। ফলত মুজিবের যে একচেটিয়া হিরোত্ব ছিল এইটা রূপ নেয় ভিলেনে। হাসিনার চেতনাশক্তি এইখানে গুড়াগাড়া হয়ে পড়ে। শেখ মুজিবের নিষ্কলুষ মূর্তিতে মুতের গন্ধ মানুষের নাকেমুখেও আসে। ফলত শেখ হাসিনার বড় খুটিটার পতন ঘটে এইখানে।

এই বড় খুঁটি পতনের মাধ্যমে শেখ হাসিনার আরেকটা খুঁটির পতন ঘটে। সেইটা হলো খুনি হাসিনা বলতো, দেশটা তার বাপে স্বাধীন করছে। দেশটা তার বাপের। বাপের সূত্রে দেশটা তার। ফলত সামন্তবাদী শাসনের একটা নামকাওয়াস্তে বৈধতা নিয়ে নিছিল। এর একটা কাব্য বৈধতাও দিছিল ইমতিয়াজ মাহমুদ, "যতদূর যাও পাখি দেখা হবে ফের, স্বাধীন এই আকাশটা শেখ মুজিবের"। এইটাকেও রুখতে হইছে জনগণের। জনতা বলছে, দেশটা কারো বাপের না। এর তাৎপর্য একদিকে যেমন হাসিনার সামন্তবাদী শাসনের বয়ানকে নাকচ করা তেমনি একটা স্বাধীন আকাশ যে শেখ মুজিবরে দিয়ে দিছে ইমতিয়াজ মাহমুদ, এর বাস্তবতাও জাহির করেছিল আওয়ামী লীগ, এইটারও বিরোধিতা করা। ফলত জুলাই অভ্যুত্থানটা ছিল দেশটাকে একজনের বাপের থেকে উদ্ধার করা এবং স্বাধীন আকাশে মুজিবের থেকে নিজেদের হিস্যা আদায় করে নেওয়ার!

জুলাই অভ্যুত্থানের মাধ্যমে জনগণ একাত্তরের প্রকৃত ন্যারেটিভও ফিরায়া আনে। তারা বলতে শুরু করে শেখ মুজিব বাংলাদেশরে স্বাধীনতা আইনা দেয় নাই। শেখ মুজিবরে মজলুমের প্রতীক কইরা বাংলাদেশের জনগণ যুদ্ধ কইরা স্বাধীনতা আনছে। আর এই পাষণ্ড মুজিব গণমানুষের স্বাধীনতারে ক্ষমতায় আইসা রক্ষীবাহিনীর মাধ্যমে গুম খুন লুট নিপীড়নের মাধ্যমে একদলীয় বাকশালের ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করছিল। ফলত হাসিনার শাসন তার বাপকেই অনুকরণ। ফলত হাসিনা পাঠ্যপুস্তক থেকে শুরু করে রাস্তাঘাটে অলিগলিতে এমনকি সংবিধানেও বাপের যে ফেইক পবিত্রায়ন করে রেখেছিল তা নিমিষেই গুড়াগাড়া হয়ে পড়ে। দেখা গেল পাঁচই আগস্ট জনতা শেখ মুজিবের মূর্তি ভাঙচুর করে, শেখ মুজিবের মাথায় বসে পেশাব করে! মানুষ বুঝতে শুরু করে আওয়ামী লীগের ফ্যাসিবাদের গড় হাসিনা না, মূলত শেখ মুজিব। হাসিনা হইলো পয়গম্বর। তারে কেবল ডুবাইলে ফ্যাসিবাদ ডুববে না, ফ্যাসিবাদের মূল হোতা শেখ মুজিবকেও ডুবাইতে হবে।‌ তারে পবিত্রকরণ করে যেন ভবিষ্যতে আর ফ্যাসিবাদের উত্থান না হতে পারে এই কাজটাও জুলাই অভ্যুত্থান করে গেছে!

আওয়ামী সুশীলদের আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ ডিসকোর্স ছিল, বিকল্প কে? মানে খুনি হাসিনার বিকল্প নাই, বাংলাদেশকে ঠিকঠাক শাসন করার মতো লোক হাসিনা ছাড়া আর কেউ নেই এমন একটা বয়ান তারা প্রতিষ্ঠিত করেছিল। বামদের ভয় দেখাতো হাসিনার উপর আস্থা না দেখালে জামাত হেফাজত দেশ দখল করে নিবে। জামাত হেফাজতরে ভয় দেখাতো তাদের উপর আস্থা না দেখালে শাহবাগীরা তাদেরকে ধ্বংস করে দিবে। হিন্দুদের ভয় দেখাতো তার উপর আস্থা না রাখলে মৌলভীরা তাদের বাড়িঘর দখল করে নিবে। এই ত্রাসগুলো দেখানোর জন্য আওয়ামী লীগ নিজেদের লোক দিয়ে পূজা প্যান্ডেল ধ্বংস করেছে, হিন্দুদের বাড়িঘর দখল করেছে! এই ডিসকোর্সকেও জনগণের ভাঙতে হয়েছে। আমিই বিকল্প বলে জনতা যখন স্লোগান তুলেছে তখন এই স্লোগানে ছিল কর্তাসত্তা তথা সার্বভৌম শক্তি। যেইটা হাসিনার দখল থেকে জনগণের মধ্যে এসে মিশে গিয়েছিল। ফলত সুশীলদের এই বিকল্প তত্ত্ব গুড়াগাড়া হয়ে গেছিল। কারণ জনগণের সার্বভৌম শক্তি রাজপথে জেগে গেলে পাল্লা দেওয়ার মতো বিকল্প আর হয় না! হওয়া সম্ভব না!

অভ্যুত্থানের আজান

জুলাই অভ্যুত্থানের আজানও ছিল। এই আজানের ভূমিকা পালন করছে দুইটা রেপ গান। এইটা নয়া বাংলাদেশের সংস্কৃতি কোন দিকে যাচ্ছে, এর ভাষাটা কেমন; এর একটা ইঙ্গিতও দেয়। নয়া বাংলাদেশ যে অধিকতর বাংলাদেশীদের হয়ে উঠতেছে, কলকাতার প্রমিত বাংলা থেকে আমাদের সাহিত্য সংস্কৃতি যে আমাদের গণমানুষের ভাষায় রূপান্তর করা দরকার এর যে তাগিদ এইটা পাওয়া যায় রেপ গানগুলোতে। রাষ্ট্রের থেইকা কিংবা শিল্প সাহিত্য থেইকা গণমানুষের যে দুরত্ব এইটা কমানোর একটা ফুরসত আসে অভ্যুত্থানে। অভ্যুত্থানের দায় থাকে বা আরম্ভই থাকে গণমানুষের একসাথে‌ বিলীন হওয়ার মাধ্যমে। ফলত এইটা করতে গেলে অভ্যুত্থানকে গণমানুষের ভাষা আত্তিকরণ করতে হয়। এই আত্তিকরণের ভাষার রূপটাই হলো আওয়াজ উডা, কথা ক নামক দুইটা গান। বাংলাদেশ রাষ্ট্রে শিল্প সাহিত্যের গণমানুষের হয়ে উঠার যোগসূত্র যে গণমানুষের ভাষা এইটা যেহেতু স্পষ্ট হয়ে গেছে ফলত বাংলাদেশের সাহিত্য সংস্কৃতিতে অপ্রমিত ভাষার শিল্প সাহিত্যের যোগান বাড়বে। আর এইটা বাড়ার ইফেক্ট রাষ্ট্রেও পড়বে। যেহেতু শিল্প ও সাহিত্য রাষ্ট্ররে অনেকটা প্রভাবিত করে। ফলত বাংলাদেশ রাষ্ট্রেরও চাপ থাকবে গণমানুষের হয়ে উঠার। এই চাপটা যতটা অপ্রমিত দিতে পারবে তাশ দশ ভাগও প্রমিত দিতে পারবে না। কেননা প্রমিতে যে আকাঙ্ক্ষা তা গুটি কয়েক মানুষের, কিন্তু অপ্রমিতের আকাঙ্ক্ষা হলো গোটা বাংলাদেশের।
জুলাই বিপ্লবের আজান হইতেছে আওয়াজ উডা। কথা ক। এই যে ডাক, এই যে আজান; এই আজান দেওয়া হচ্ছে নিপীড়িত মজলুমদের উদ্দেশ্যে। খুনি হাসিনার ফ্যাসিবাদে মজলুমদের যে কর্তা সত্তা বিলীন হয়েছে, যে দাসত্ব সত্তার উদ্ভব ঘটেছিল এর বিরুদ্ধে গিয়ে কর্তা সত্তা তথা জবানকে জাগ্ৰত করার আহ্বান জরুরি ছিল। রাষ্ট্রের মালিকানা থাকে মূলত জনগণের জবানে, এইটা রেপার হান্নান আর সেজান ভালো করে বুঝতে পারছিল। ফলত জবানকে তথা কর্তা সত্তাকে হাসিনা যে স্তব্ধ করে দিছিল এই ব্যারিকেড ভেঙে দেওয়ার আজানটা তাদের দিতে হইছে। এই আজান যে দাসত্বের ধ্বংস এবং নির্মাণের ওঙ্কার এইটা ভালো করেই বুঝতে পারছিল হাসিনা। ফলত রেপার হান্নানকে বন্দী করে।

"রাস্তায় এত রক্ত কাগো? আওয়াজ উডা বাংলাদেশ
রাস্তায় গুল্লি করলো কেডা? আওয়াজ উডা বাংলাদেশ"

প্রকৃত শিল্পী তথা বিপ্লবীদের একটা বড় দায়িত্ব হইতেছে জালিম ও মজলুমের ফারাক করা, এবং চিহ্নিত করা। পৃথিবীতে বর্গ যে মূলত দুইটাই, একটা জালিমের আরেকটা মজলুমের এইটা ফুটায়া তোলা জরুরি। আরো বলা জরুরি যে পৃথিবীতে যত বর্গ আছে সব ফেইক, সত্য কেবল মজলুম এবং জালিম বর্গ। দেখ, হাসিনা যে খুন করতেছে হিন্দু মুসলমান বাইছা খুন করতেছে না, শাপলা শাহবাগী বাইছা খুন করতেছে না, শ্রমিক মালিক বাইছা খুন করতেছে না, আস্তিক নাস্তিক বাইছা খুন করতেছে না, লেখক অলেখক বাইছা খুন করতেছে না, কৃষক ছাত্র বাইছা খুন করতেছে না, এলিট মধ্যবিত্ত গরীব বাইছা খুন করতেছে না। সে খুন করতেছে যারাই খুনি হাসিনার জুলুমের বিরুদ্ধে দাড়াইতেছে। ফলত হান্নান বলতেছে রাস্তায় এতো রক্ত কাগো খবর লও, রাস্তায় গুলি করলো কেডা ভালো করে তাকায়া দেখ, তোমার পক্ষ বাইছা লও!

"আমরা বলে রাজাকার কয় দি দেশের রাজাকার"

হাসিনা যে রাজাকার ট্যাগ দিলো মুক্তিকামীদের, এইটা যে একটা জোক, এইটাই মূলত এইখানে বলা হইছে। জোকই তো, রাজাকারের মূল অর্থ ছিলই তো আজাদী বিরোধী, আর হাসিনা ছিল সেই আজাদী বিরোধীদের প্রধান সশস্ত্র নেতা। ফলত সে যখন কাউকে রাজাকার বলে সেইটা হয়ে উঠে হাস্যকর। যেই রকম পাছায় ত্যানা নাই লোকে আরেকজনরে ভ্যাঙায়, তোর মাথায় টুপি নাই বইলা; এইরকম রিয়েল হাস্যকর ঘটনা আর কি!

"ছাত্র আওয়াজ না উডাইলে দেশের ভিত্তে হাহাকার

গণঅভ্যুত্থানে ছাত্ররা ছিল মাঠের অগ্ৰভাগের সৈনিক। এদের কর্তাসত্তাই প্রথম জাগ্ৰত হইছিলো। যেইটা বাতাসে ছড়ায়া গেছিল সারা দেশে, সমস্ত মজলুমদের রুহে। যেইটার ফল আজকের নয়া বাংলাদেশ। জনতার মধ্যে যখন হাহাকাররে ভাষা দিয়ে কর্তাসত্তা জাইগা উঠে তখন আর হাহাকার থাকে না, চোখে চোখ রাইখা জবান কথা কয়। জবাবদিহিতা চায়, যার জবাব নাই!

গদিত বইসে স্বৈরাচার কত কিছু সইয়া আর
তর position টিক্কা থাকবো কত ভাই ক মইরা আর?
নামসি বুকে পতাকা, দেশ বেচতাসোস কয় টেকা?
সিলেট যহন ডুইব্বা গেসে পানি আইসে কই থেকা?
আবু সাঈদরে গুল্লি করলি order দিলো কই থেকা?

এই প্রশ্নগুলোর উত্তর হয় না। কারণ এগুলো মজলুমের বিলাপ। বিলাপের বিরুদ্ধে কেউ কখনো দাঁড়াতে পারে না। এইখানে হান্নান আরেকটা জরুরি পয়েন্ট যোগ করছেন। ইণ্ডিয়ার জবরদস্তির শোষণ আর হাসিনার ফ্যাসিবাদ যে একসূত্রে গাঁথা এইটা তিনি তুইলা আনছেন। হাসিনা যে ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য ইণ্ডিয়ার উপর নির্ভরশীল হয়া গেছিল, জনতার উপর নানান অন্যায্য চুক্তি চাপায়া দিছিল, জনগণের ন্যায্য হিস্যার বদলে সবসময় অসময়ে পানি ছাইড়া বলি দিতেছিল জান মাল, এইটাও হাসিনাকে চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে জড়িত এইটা বুঝতে পারা ভালো রাজনৈতিক বোঝাপড়া। আর হাসিনার আন্দোলন দমনে খুনখারাবিতে ইণ্ডিয়ার সহযোগিতা নিয়েও পূর্বের প্রশ্নগুলোর রেষ ধরে জিজ্ঞাসার স্বরে ইণ্ডিয়ারে দায় দিছেন। জালিমের তো এই প্রশ্নগুলোর জবাব দেওয়ার কিছু নাই। হান্নান জবাব পাওয়ার জন্যেও প্রশ্নগুলো করেন নাই। বরং সত্য হিসেবেই প্রশ্ন করছেন। এসবের উত্তর হয় না। ফলত খালি অপশন থাকে ধ্বংস হওয়ার। আর এইটা পাওয়া যায় গানের ঠিক পরের চরণটাতে!

"এবার রাস্তায় লাখো সাঈদ কইলজা থাকলে ঠেকাগা!"

জিদ দেখছেন? মূলত এই জিদ দিয়াই আমরা হাসিনার পতন ঘটাইছি। যেইটা দেইখা ডরায়া গেছিল হাসিনার বাকশালী পুলিশ। কইতেছিল, আতঙ্কের হইতেছে একটারে মারলে একটাই সরে, বাকিগুলো সরে না। আরো বিশটা আসে। এই জিদের কাছে জুলুম টিকে না।

"আমার বইন যে মাইরা দিলি তর ঘরের টা মারতি তুই?
তর না দেইক্ষা মাইরা দিলি নিজের ওইলে পারতি তুই?
হকের কেউ খাইয়া লাইলে এমনে কি আর ছারতি তুই?
একটা মারবি দশটা পাডাম আর কয়ডারে মারবি তুই?"

এইটা হইতেছে মাইণ্ড গেইম। আবেগের খেলা। জালিমের মধ্যে আবেগ ঢুকায়া দেওয়া, নিবৃত্ত করার চেষ্টা। আমার বইন রে মারছছ, তর বইন হইলে মারতে পারতি? তোর হক কেউ খায়া দিলে ছাইড়া দিতি? যেহেতু এইটা ছিল একটা লড়াইও ফলত আবেগকে এইখানে হান্নান অস্ত্র করে নাই, অস্ত্ররেও সামনে রাখছে। একটা মারবি দশটা পাডাম বলে হুঁশিয়ারি দিছে। এই হুঁশিয়ারি যে কাজের ছিল এইটা বাকশালী পুলিশ বাকশালের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীরে বলতেছিল, যে একজন গেলে দশজন আয়ে, এইটা আতঙ্কের স্যার।

"শহিদ হইলো আবু সাইদ এরপর গেলো আসিফও
রাফি গেলো তারও পরে গেলো ওয়াসিম আদনানও
সোনার বাংলা রয়া যাইবো সোনার ছেলে বাদ্দা গো
কাপুরুষ এর পরচিয় তগো কইলজা রাখসি মাপ দা গো
ছাত্র ছাড়া লীগ হয় নাই তর লীগের কামডা ঠিক হয় নাই"

এরপর শহীদি বিলাপে গেছেন হান্নান। শহীদদের নিয়ে বিলাপ জরুরি। এই বিলাপই মূলত আন্দোলনকে জনতার মধ্যে জাগিয়ে রাখে। আন্দোলন তথা অভ্যুত্থান জনতার মধ্যে জাগিয়ে রাখা মানে যেইসব জুলুমের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান হইছে এই আকাঙ্ক্ষার একটা কনশাস সমাজে জারি থাকা যেইটা অটোমেটিক্যালি জুলুমের বিরুদ্ধে লড়াই করে যায়। শাপলারে আমরা দেখছি এই কান্না তথা বিলাপ জারি রাখতে পারে নাই। নানান সময়ে বরং এই বিলাপরে বিক্রি করা হইছে হাসিনার সাথে ক্ষমতা এবং স্বার্থের লোভে।‌ ফলত ঐ সময়ের এতো বড় একটা গণহত্যা জনগণের মধ্যে যে আঁচড় ফেলার কথা এবং এইটা নিয়ে মজলুমের জালিমের বিরুদ্ধে যে রাজনীতি হওয়ার কথা তা হয় নাই। বরং জালিমকে জননীর খেতাব দেওয়া হইছিল। আর শহীদদেরকে দেওয়া হইছিল পরিচয়হীন মর্যাদাহীন পশুর জীবন। তাদেরকে স্মরণ করা হয়নি। তাদের নাম নিয়ে বিলাপের কোনো আয়োজন ও পরিবেশও হেফাজতে ইসলাম করেনি। দুঃখজনক!

স্বাধীন বাংলা কইসে খালি বাংলা আর স্বাধীন হয় নাই
দেশ টা যে কারো বাপের একা ওর বাপে কয়া যায় নাই
হের বাপে যা কইরা গেসে ওর ভিত্তে এডি রয়া যায় নাই

বাংলাদেশের মানুষ যে কেবল প্রহসনের মধ্যে গেছে ইতিহাস এর অন্যতম স্বাক্ষী। সাতচল্লিশে রক্ত দিয়া আন্দোলন কইরা রাজনৈতিক বোঝাপড়ার মধ্য দিয়ে পাকিস্তান কায়েম করলো। নিজেরা স্বাধীনতার স্বীকৃতি পাইলো। কিন্তু স্বাধীন হইতে পারে নাই বাস্তবে। ফলত একাত্তরে তার উপরে চাইপা আসা যুদ্ধটা তার করতে হইছে। তখনও একটা রাষ্ট্র গঠন হইলো। কিন্তু এই রাষ্ট্রও যে আকাঙ্ক্ষা নিয়ে যুদ্ধ করা হইছিলো তার বলি দিয়া শোষণ চালায়া গেলো তিপ্পান্ন বছর। এরপর আবার চব্বিশের জুলাইয়ে আর স্বাধীনতার লড়াই করতে হইলো। মানে স্বাধীনতা কায়েমের জন্য জমিতে ধানের চারা রোপণ করে, নিড়ানি দেয়, সার দেয় সেচ দেয়া, কিন্তু যখন ধান পাকে লাঠিয়াল বাহিনী তা দখল করে নেয়। ইতিহাসের এই নির্মম সত্য স্মরণ করায়া দিছে হান্নান। কিন্তু হান্নান এইখানে একটা ভুল করছে। মুজিবরে ঠিকঠাক বুঝতে পারে নাই রেপার হান্নান।
(চলবে)